ছোট্ট বাবুই পাখি। নিজের বাসা নিজেই বুনে নেয়। এই তার গৌরব। এই তার স্বাধীনতা। তাই তো সোনার খাঁচায় বন্দি পাখিটিও নিয়তই মুক্তির জন্য প্রাণপাত করে যায়। কেননা গণ্ডির জীবনে সুখ নেই। খোলা হাওয়ায়, মুক্ত আকাশে উড়ার যে সুখ, তা কী আর মিলবে অধীনতার দুধে-ভাতে!
পোষা জীবনে আদর আছে, আপ্যায়ন আছে, যেমন খুশি করার, তেমন খুশি চলার সুযোগ আর কই! কর্তার ইচ্ছায় যেখানে কীর্তনÑ সেখানে আত্মমর্যাদার কোনো অধিকার আসলে থাকে! মানবিক মূল্যবোধের স্থান সেখানে কোথায়!
পাখির কথা বরং থাক। এবার মানুষের কথায় আসি। কারণ মানবিক এলে, আসে মানবতা, আসে মানুষের কথা। কবিগুরু আবার কিন্তু এই মানুষে আর বাঙালিতে ফারাক করে দিয়েছেন। বলেছেন-
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।
বাঙালির শত-হাজার বছরের ইতিহাসের এই চিরন্তনী পঙক্তিতে প্রথমবারে ছেদ মতো টানেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বজাতিকে স্বাধীন-সার্বভৌম লাল-সবুজের পতাকাশোভিত বাংলাদেশ উপহার দিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর আবেগি উচ্চারণ-
‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাঙালি আত্মমর্যাদার মর্মবাণী পেল। মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টিকে দাম দিতে জানলো।
পথভ্রষ্টরা অবশ্য তখনো চড়াই হয়ে উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজেই থাকলো। তারা অন্যের পাকা বাড়ির পরগাছা জীবনের পথেই আরাম খুঁজে যেতে লাগলো। তাই একাত্তরের পরও ধার করা জাতীয়তার একুশ বছরের অন্ধকার একটি যুগ এসেছিল বাঙালির জীবনে। বঙ্গবন্ধুহীনতার সেই যুগে খালে আর আলে তখন কেবল সমৃদ্ধির কুহক। ভেকের এই সময় আর কতকাল টেনে নেওয়া যায়! তাই আবার আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরশীলতার মহাসড়কে উঠতে পেরেছে বাংলাদেশ।
বাংলার দামালদের ক্রিকেট বিজয়ে আজ বাঘের বীরত্ব-ভূষণে আমরা। বাবুইয়ের মতোই বুননে বুননে পোশাকে পোশাকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ এবং মেড ইন বাংলাদেশ। বৈদেশের জীবনে বাঙালি ভাই, বাংলাদেশি বোনের ঘামে-শ্রমে পদ্মাপারে উঠছে আমাদের পয়সার সুবিশাল সেতু। গরিব কিষাণ-কিষাণীরা নিপুণ ফলায়, সোনালি ফসলে উধাও আজ মহা-মঙ্গা।
বাঙালির এই অসীম শক্তির উদ্বোধন করে দিয়ে গেছেন জাতির জনক। সেই ঐকতান মেনেই বঙ্গবন্ধু-কন্যা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন আজকের বাংলাদেশ, দিয়ে চলেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা। তার ফলেই তো বড় গৌরবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীর প্রতি দেশবাসীর মুখে আজ দৃপ্ত উচ্চারণ-
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।
রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ আজ বাংলার ঘরে ঘরে। এই সুখে কিন্তু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, ভালো পরা বড় বিষয় নয়। এই সুখ আত্মমর্যাদাবোধের। এই সুখ স্বনির্ভরতার। এই সুখ স্বয়ংসম্পূর্ণ এক বাংলাদেশের, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার। এই পথেই তো আছি আমরা। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ।
বিজয়ের আহ্বান চারদিকে। লাল-সবুজের পতাকাতলে একতার সুরতান। জাগো, জেগে উঠো। চলো বাঙালি, চলো সবাই।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক