মুক্তবার্তা ডেস্কঃ আগস্ট বাঙালির জন্য বেদনাবিধুর শোকের মাস। বাঙালির জীবনে প্রতি বছর এ মাস আমাদের স্মরণপথে নিয়ে আসে ১৯৭৫-এর আগস্টের সেই বিভীষিকাময় অমারজনীর কথা যখন দেশবৈরী সাম্প্রদায়িক কুচক্রীচক্রের সমর্থনপুষ্ট কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘুমন্ত নিরস্ত্র পরিবারের উপর পাশবিক আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিদেশে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান শুধুমাত্র তাঁর দুই কন্যা যাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠজন বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেত্রী ও সর্বজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। এই আগস্ট মাসেই প্রাণঘাতি আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিলেন তিনিও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপরও সেই একইরকম পাশব প্রতিহিংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ৭৫-এর হন্তারকদের উত্তরসূরি দানবেরা। এই প্রতিহিংসার মূলে প্রধান জলসিঞ্চনকারী ছিলো ৭১-এর পরাজিত শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্ত। হ্যারল্ড উইলসন যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে তিনি একজন বাঙালি সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘এটা আমার পক্ষে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, তবে আপনার জন্য একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি’। এর সাথে পূর্বাপর আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ এই মাসকে বাঙালির জন্য মহাশোকের মাসে পরিণত করেছে। এই মাসে আমরা হারিয়েছি জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণে পথিকৃত দুইজন মহাপুরুষকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। পরবর্তীকালে আগস্ট মাসে আমরা আরও হারিয়েছি স্বাধিনতা-উত্তর বাংলা ভাষার সবচে’ প্রতিনিধিত্বশীল কবি শামসুর রাহমান এবং অমিত প্রতিভাবান ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক ও প্রথাবিরোধী কবি হুমায়ূন আজাদকেও। আর ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুবরণ করেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরীহ মানুষ যারা মিলিত হয়েছিলেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এক সমাবেশে। আগস্টে ঘটা এসকল মৃত্যু কোনক্রমেই সাধারণ মৃত্যুর ঘটনা নয়, কেননা জাতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সেবকদের তিরোধান আমাদের জীবনে একটি শূন্যতা তৈরি করেছে যা পূরণ করা অসম্ভব। সে কারণেই আগস্ট কেবল শোকের মাস নয়, স্মরণ করার মাসও। জনগণ অত্যন্ত সম্মানের সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়ভাবেই আমাদের জাতীয় পরিচয় পুনর্গঠনে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৯ ই আগস্ট এবং কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট নিহত হন। কবি হুমায়ূন আজাদ ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট এবং কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। বিভিন্ন সময়ে এক মাসে এই মৃত্যুগুলি উপমহাদেশের জন্য, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য আগস্ট মাসকে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাসে পরিণত করেছে । কিন্তু সকল মৃত্যুর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের ঘটনা বিশেষত বাঙালির জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি, এক গভীর বেদনার উৎস, কেননা বঙ্গবন্ধু এই জাতিকে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ে উদ্বোধিত করেছিলেন।
১৯৭১-এ এক সমুদ্র রক্তে অবগাহন করে যে বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, তার হৃদয়ে বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল যাঁর স্বপ্নদর্শী দিকনির্দেশনায়, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অন্তর-লালিত স্বপ্ন, তাঁর মহাকাব্যিক জীবনের কর্ম, তাঁর প্রতিশ্রুতিরাশি একাকার হয়ে বাঙালিত্বের চেতনা বিনির্মাণ করেছে। বাঙালির সহস্রবর্ষের ইতিহাসে মননে বিশ্বাসে ও কর্মে পরিপূর্ণ বাঙালি তিনি। সাংবাদিক সিরিল ডান যেমনটি বলেছেন, “বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে বংশ, জাতিসত্ত্বা, ভাষা, কৃষ্টি ও জন্মসূত্রে পরিপূর্ণ বাঙালি একমাত্র নেতা শেখ মুজিব। তাঁর দৈহিক আকৃতি ছিল বিশাল। তাঁর কণ্ঠস্বরে বাজত বজ্র নির্ঘোষ। গণমানুষের উপর তাঁর ক্যারিশমা যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাঁর সাহস এবং আকর্ষণ তাঁকে সমকালের একজন অনন্য অতিমানবে পরিণত করেছে।” মিশরের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নাসের যেমন সমগ্র আরববাসীর নিকট তাঁর আরবীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সীমা পেরিয়ে সারা বিশ্বের সকল বাঙালির কাছে মুক্তিপ্রদায়ক হিসেবে বরণীয় হয়েছেন। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালির জন্য এক নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্বোধন করেছে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীরা তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে যুগ যুগ ধরে যে পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে, তার পথে বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হানাদার বিজাতীয় শক্তি। বাঙালি বারবার পরাধীনতার শৃঙ্খল পরেছে তার পায়ে। বারবার মৃত্যু ঘটেছে তার আপন অধিকারবোধের। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই হৃত অধিকারবোধ। তাঁর গগণবিস্তারী হৃদয়ে প্রোথিত ছিল মুক্তপ্রাণ বাঙালির অবিনাশী চেতনা। তিনি সেই চেতনা সঞ্চারিত করেছিলেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। স্বীয় অধিকারবোধের সেই চেতনা বাঙালিকে দিয়েছে মুক্তির দিশা, পৌঁছে দিয়েছে তাকে স্বাধীনতার সুবাসিত বন্দরে, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক বঙ্গসন্তান গর্বোদ্ধত মাথা আকাশে তুলে তার আপন ভাষায় চীৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে পারে।
ভাষা যেকোন জনগোষ্ঠীর জন্য সাংস্কৃতিক বন্ধনরজ্জু হিশেবে কাজ করে। তাই জাতীয়তাসংগঠনে ভাষাভিত্তিক ঐক্য একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। জাতি গঠনের মূল ভিত্তিভূমি নির্মাণে জাতি হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করার এষণা এবং যৌক্তিক উপায় থাকা দরকার। এ দুয়ের সম্মিলনে নির্মিত হয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। জাতীয়তাবাদী চেতনা নির্মাণ ও এর প্রসারে জনগোষ্ঠীগত যে আন্তঃসংযোগ প্রয়োজন তার প্রধান বাহন ভাষা। ভাষার ঐক্য না থাকলে সাংস্কৃতিক সম্মিতি রচিত হয় না। তাই একই ভূখণ্ডে ভিন্নভাষী জনগোষ্ঠী বাস করলে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েই যায় যতক্ষণ না প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে যে কোন একটি প্রধান ও সার্বজনীন হয়ে ওঠে। ভৌগলিক সীমাকে উপজীব্য করে যখন কোন জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়, তাতে একাধিক ভাষাভিত্তিক জাতিসত্ত্বা অঙ্গীভূত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান ও সার্বজনীন ভাষাটির আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। উদাহরণ স্বরূপ ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দি ভাষার কথা বলা যায়। জাতিরাষ্ট্র গঠনে যেহেতু রাজনৈতিক প্রভাব প্রায়শ প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, সেহেতু অনেক সময় জাতি গঠনের সকল উপাদান বর্তমান থাকার পরও কোন কোন জনগোষ্ঠী জাতিরাষ্ট্র সংগঠনে ব্যর্থ হয়। যেমন ঘটেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশপরবর্তি বাংলার ক্ষেত্রে। ১৯৪৭ সালে মুসলীম লীগ প্রচারিত সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বিদায়ী ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা ব্যবহার করে অখণ্ড ভারতকে দু’ভাগ করে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধকে স্থায়ী রূপ দিয়ে যায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ সেই সময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলমান রাজনীতির আবর্তে পড়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যায়। ইত্যবসরেতিন বাঙালি নেতা আবুল হাশেম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎচন্দ্র বসু বঙ্গকে অবিচ্ছিন্ন রাখার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তারা ব্যর্থ হন। সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠকণ্ডয়ূক নষ্ট রাজনীতির প্রভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের লু-হাওয়া পুরো উপমহাদেশে অপ্রতিহত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত বিভাগের সাথে সাথে বঙ্গ প্রদেশও বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমাংশ ভারতে যোগদান করে এবং পূর্ব অংশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয়। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ধর্ম তথকথিত জাতিরাষ্ট্র গঠনের নিয়ামক হয়ে ওঠে এবং ভৌগলিক সংশ্লিষ্টতাবিহীন ভিন্ন সংস্কৃতির ভিনভাষী একাধিক জনগোষ্ঠীর উপর জোরপূর্বক জাতীয়তা আরোপ করা হয়। এ ধরণের আরোপিত জাতীয়তা কোন জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্বারা উদ্বোধিত হতে পারে না এবং এর পতন অনিবার্য। পতনের অনিবার্যতা বুঝতে পেরে ভারতবিভাগ পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রবাসী ক্ষমতাধরেরা ভাষিক উপনিবেশ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্য বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষিত নবীন বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত বুঝতে পেরেছিল যে তারা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি বরং উপনিবেশবাদের এক নতুন রূপ ইসলামের নামে তাদের ওপর চাপানো হয়েছে। তারা আশ্রয়নিয়েছিলেন তাদের সাংস্কৃতিক দুর্গে যা চর্যাপদ থেকে ময়মনসিংহ গীতিকা এবং আলাওল, চন্ডীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত এবং শামসুর রাহমান পর্যন্ত এক হাজার বছরের ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরাধিকার ছিল। এই বাঙ্গালীদের যখনই আক্রমণ করা হয়েছিল, তখন তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের রক্ষা করেছিল। অবাঙালি পাকিস্তানি শাসকরা প্রথমে বাংলার এই সাংস্কৃতিক দুর্গটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। তারা বাংলা ভাষাকে হিন্দু ভাষা বলে অবজ্ঞা করার চেষ্টা চালয় এবং বেশিরভাগ বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ইসলামবিরোধী বলে গালমন্দ করে। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি জাতিগতভাবে বিশ্বস্ত বাঙালি রোষভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল, প্রতিরোধ করেছিল সেই অপচেষ্টার এবং পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য ভাষাসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে জাতীয়তাবোধের ঐকতান সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজেদেরকে আপন আলোয় চিনেছিল; দাঁড়িয়েছিল সকল চাপিয়ে দেয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল তুলে; শিখে নিয়েছিল কীভাবে ভাষার আখরে দেশাত্মবোধ রচনা করতে হয়। সেই প্রতিরোধ সংগ্রামের একজন নির্ভীক সেনা কালক্রমে হয়ে ওঠেন এ জাতির প্রকৃত মুক্তিদাতা, জাতির পিতা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও বাংলা ভাষাভাষী পূর্ববঙ্গীয় জনগোষ্ঠী প্রকৃত অর্থে তখন মুক্তি পায় নি। মূলতঃ তারা আবারও ঔপনিবেশিক শাসকের করতলগত হয়ে পড়ে। সহস্র যোজন দূরের এক ভূখণ্ডের ভিন্ন ভাষাভাষী শাসকের রক্তচক্ষু আবারও বাঙালিকে উৎপীড়ন করতে থাকে। জাতিগঠনের দু’টি মূল উপাদান ভূখণ্ডগত ঐক্য ও অভিন্ন ভাষার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের বোধ জাগ্রত হওয়া সম্ভব ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের নিজেদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। ফলতঃ বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের সংবিধানে বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান নামে অভিহিত করে। হাজার বছরের ঐতিহ্যশালী এক ইতিহাসকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তারা বাঙালির ললাটে ‘পাকিস্তানী’ নামের টীকা চাপিয়ে দেয়। ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশ’ শব্দ দুটির উচ্চারণও তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে বিদ্রোহের শামিল ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালি, তার ইতিহাস, তার ঐতিহ্যের পক্ষে সরব হওয়া প্রথম মানুষটি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন “জনাব স্পীকার, তারা পূর্ববাংলার নাম পাল্টে পূর্ব-পাকিস্তান রাখতে চায়। ‘বাংলা’ নামটি ব্যবহারের পক্ষে আমরা সবসময় দাবী করে এসেছি। বাংলা অভিধাটির পেছনে একটি ইতিহাস আছে; একটি ঐতিহ্য, একটি পরম্পরা রয়েছে। যদি এই নাম পরিবর্তন করতেই হয়, তবে বাংলার মানুষের সামনে এই প্রশ্ন রাখা উচিৎ: তারা কি তাদের পরিচয় পরিবর্তিত হতে দিতে ইচ্ছুক?” বঙ্গবন্ধুর এই দাবী সেদিন অগ্রাহ্য হয়েছিল। বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর এই অনুভব ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণের সাথে সমানুপাতিকভাবে পরিণত হয়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ যখন তিনি গ্রেপ্তার হন তখনো তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আপামর বাঙালির জন্য তাঁর হৃদয়কন্দরে সহমর্মিতার ফল্গু বহমান ছিলো আজীবন। ন্যায়ের পক্ষে সদা সোচ্চার থাকার প্রতিদান হিসাবে তিনি ব্যক্তিগত ক্ষতি অম্লানবদনে নিত্যই সয়েছেন। এই ন্যায়ধর্মে উজ্জীবিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অপরাধে তিনি ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। ফলে অকালে তাঁর ছাত্রজীবনে যবনিকাপাত ঘটে। কিন্ত‘ এ ক্ষতি তাঁকে আপন উদ্দেশ্য থেকে হঠাতে পারেনি। আপসহীন এই মহান নেতা সহ্য করেছেন নিগ্রহ ও কারাদন্ড বারংবার। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যও লক্ষ্যচ্যুত হননি। ৪৮-৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচনের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনসহ আর্থ-সামাজিক অধিকারের আন্দোলন, ৬০ দশক জুড়েই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন, ৬২’র শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের প্রতিবাদে তীব্র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬ থেকে ছয় দফা দাবী আদায়ের আন্দোলন এ সবকিছুতে বঙ্গবন্ধু বাংলার অন্ধকার ভাগ্যাকাশে এক অত্যুজ্জ্বল তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন যুগ যুগ ধরে দলিত, নিপীড়িত, সর্বস্বাপহরিত এই জাতির ভগ্নতরণীর অকুতোভয় কান্ডারী হয়ে তাদের মুক্তির আনন্দবন্দরে পৌঁছে দিতে। ৬৬-তে যে ছয় দফা দাবীর উত্থাপন তিনি করেছেন ৬৮,৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান অতিক্রম করে, ৭০’র নির্বাচনে সমগ্র বাঙালির যে দাবীর প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন ছিল, সেই দাবীর মধ্যেই স্বাধীনতার মূল প্রবাহটি ফল্গু ধারার ন্যায় বিদ্যমান। একটি দেশে যখন স্বতন্ত্র কারেন্সীর কথা বলা হয়, স্বতন্ত্র সামরিক বাহিনীর কথা বলা হয় তখন সব শর্তের মধ্যে স্বাধীনতার শর্তটিই কেবল প্রকট আকার ধারণ করে। পাকিস্তানী জান্তাও জানত যে স্বাধীনচেতা বাঙালী জাতি ৬-দফা দাবীসমূহের স্বীকৃতি পেলে আরো বড় অর্জনের দিকে ধাবিত হবে এবং তার ফলে। পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে: If the six Point Programme were implemented, the ruling coterie was afraid, it would lead to the disintegration of Pakistan. … The Six Point formula was not only a listing of Bengali grievances, it was a manifestation of their determination to take charge of their affairs by themselves.
ছয় দফার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মুখপাত্র রূপে আবির্ভূত হন। কারণ তিনি এই স্বপ্নকে সার্বজনীন করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি বাঙালী জাতির অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এতটাই সুদৃঢ় করে দেয় যে, আইয়ুবশাহী ও তার দোসরেরা যারপরনাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখার নীতি অবলম্বন করে। জাতিকে শোষণ নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধ– তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে মূল্যহীন জ্ঞান করেন। এর প্রতিদানে পুর্ববাংলার জনগণ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করেন (২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। “বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তারা এক অবিসংবাদী নেতৃত্বকে খুঁজে পান যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের মধ্যে প্রায় ১২ বছর সময়কাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন। ১২ বছরের কারাজীবন ও ১০ বছর ধরে নিরাপত্তা রক্ষীদের শ্যেণ দৃষ্টির মধ্যে মুজিবের জন্য পাকিস্তান মুক্ত রাষ্ট্র নয়, বরং ছিল একটি বিশাল বন্দীশালা।” সুতরাং বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবন পাকিস্তানী শাসনামলে প্রতিটি বাঙালির অনুভূতির প্রতীকি প্রকাশ হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বে বাংলার জাগরণ তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। তাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো ৬-দফার উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দেয়া। এজন্য তারা অত্যন্ত কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে এবং একে প্রত্যাখ্যান করে। এই পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর কাজকে অনেকটা সহজ করে দেয়। স্বজাতির স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে সুদৃঢ় পণ, অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং তীক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে একমাত্র ভরসার স্থল করে তোলে। তিনি বাঙালির অগ্রনায়কে পরিণত হন; একই সঙ্গে পরিণত হন ধিকৃত সাম্রাজ্যবাদীদের আতঙ্কে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি বলেন যে, বাঙালির ইতিহাস এবং উচ্চাভিলাষকে মুছে দেয়ার চেষ্টা চলেছে। শুধু বঙ্গোপসাগরের নাম ছাড়া আর কোথাও বাংলা অভিধা ব্যবহার করা হয় না। তিনি এরপর ঘোষণা করেন যে, এরপর থেকে পাকিস্তানে পূর্বাঞ্চলীয় এই প্রদেশটি ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর বদলে বাংলাদেশ নামে পরিচিত হবে। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় বাংলাদেশ নাম আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়। একে বলা যায় স্বতন্ত্রতার দিকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭০-এর নভেম্বরে এক বেতার ভাষণে বলেন – ”নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশকে সংকটমুক্ত করতে চাই … গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায় অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। … জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে স্বশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের গুরুভার বহন করতে দেয়া কোন প্রকারেই উচিত নয়। রাজনীতিতেও সশস্ত্র বাহিনীর জড়িয়ে পড়া একেবারেই অনুচিত। … প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। … আগামী নির্বাচনে আজাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটবে।” বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশের ছবি এঁকে দেন সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে। তিনি সময়ের উত্তাপ অনুধাবন করেন এবং ৭ মার্চ, ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অগণিত মানুষের সামনে বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে অগ্নিস্রাবী, সবচেয়ে সময়োপযোগী ভাষণে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল জনসভায় তিনি সমগ্র বাঙালির অনুভুতির প্রতিফলন ঘটিয়ে ঘোষণা করেনঃ “আমার অনুরোধ, প্রত্যেক গ্রামে,মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবা আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবো, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ ।” মানুষ ভোলেনি তাঁর স্বাধীনতার আহবান ‘‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। শত্রুকে আমরা হাতে মারবো, ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। অর্থাৎ স্বাধীনতা চাই এবং সে কারণেই এবার মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হোক।” তিনি ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তিপথের দিশা ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা ।” ৭ই মার্চের ভাষণ মুক্তিসংগ্রামের অনুপ্রেরণা, বাংলার স্বাধীনতার সনদ, আমাদের লাল- সবুজের পতাকা, স্বাধীন জাতিসত্ত্বার অহংকার, জাতির পিতার অমিয় বাণী, বিশ্বব্যাপী বাঙালির জন্য সর্বকালের দিক-নির্দেশনা এবং সর্বোপরি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অন্যতম দলিল। এরই পটভূমিতে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে যখন পাকিস্তানী জান্তার রক্তলোলুপ থাবা নিয়তির মতো আছড়ে পড়লো ঘুমন্ত নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালির উপর আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী সেনা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে এলো, তখন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে, সমগ্র বিশ্বের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন: I appeal and order you all in the name of the Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E.P.R of Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight. No comprise. Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you. Joy Bangla.
এই ঘোষণা শুধু মুহূর্তের আবেগে উচ্চারিত পংক্তিমালা নয়, এটা একটা নিষ্পেষিত, পদদলিত জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার হুঙ্কার, যে হুঙ্কার ধ্বনিত হয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের কণ্ঠে যা এক ঐন্দ্রজালিক সম্মোহনের মতো গোটা জাতিকে বেঁধেছে এক লক্ষ্যের সুতোয়, যা বাংলার তমসাময় আকাশে এনে দিয়েছে নতুন দিনের সূর্য, বাঙালী পা রেখেছে এক নতুন যুগে। সেদিনের সেই দৃঢ় উচ্চারণ আপামর বাঙালির জন্য ছিলো ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা যা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে প্রবল পেশীশক্তির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবেই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি একটি মুক্ত ভূখণ্ড। এই অর্জন কখনোই সহজ ছিল না। বরং রক্তের সমুদ্র সাঁতরে বাঙালিকে মুক্তির উপকুলে ভিড়তে হয়েছে। এই গৌরবের ঠিকানায় পৌঁছুতে যে সাহসী এবং প্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিলো তা বাঙালি খুঁজে পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন লালিত ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। ৭২-এর ২৬ মার্চে বেতার ও টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন : “শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সেই বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে।” ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু আরো বলেন: ‘‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা। … আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকুরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে ¬ পূর্ণ হবে না। …আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরোপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।” ধবংসস্তুপের উপর সমৃদ্ধির ইমারত গড়তে যে সময় প্রয়োজন, সংগ্রামোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় দেয়া হয়নি।নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস! যে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু জীবনপণ করেছিলেন, সেই স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর তাঁকে কৃতঘ্ন ঘাতকের নির্মম বুলেটের শিকার হতে হয়েছে। ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলেও তাঁর বিস¥য়কর ব্যক্তিত্বকে হত্যা করতে পারেনি, তাঁর উত্তরাধিকারকে হত্যা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সত্যিকার মুক্তি — ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অবিচার থেকে, নির্যাতন থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর নেতৃত্বের উত্তরাধিকার। বাবার আদর্শকে সমুন্নত রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা আত্মনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এই পথে বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে বহু ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। স্বৈরাচারের শ্যেণ দৃষ্টির নাগপাশে অন্তরীণ থাকতে হয়েছে বহুদিন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। পাকিস্তান আমল তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা বাংলা ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও বিজাতীয় ঊর্দুকে বাংলার উপরে স্থান দিতে চেয়েছিল; যারা মুক্তিকামী বাঙালিকে হিন্দু ও কাফের বলে গালি দিয়েছে; যারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার স্বপ্ন এখনও দেখে, সেই সব জামায়াতি চক্র এখনও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে চলাফেরা করে। শুধু তা-ই নয়, তারা ১৯৭১-এ তাদের ভূমিকার জন্য কখনো অনুশোচনাগস্ত হয়নি, বরং কৃতকর্মের জন্য তারা গর্বিত এবং উচ্চস্বরে তারা এর সাফাই গেয়ে এসেছে। এই সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার এদেশের মাটিতে না হলে বঙ্গবন্ধুর আরব্ধ স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কেননা বঙ্গবন্ধুর লালিত চেতনার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িকতার প্রচণ্ড বিরোধ রয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাই একটি অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজে হাত দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। কাজটি দুরুহ হলেও সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর আপসহীনমনোভাব ও নিজ জাতির প্রতি সুগভীর মমত্বকে আপন হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু-দুহিতা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে অনন্য সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁকেও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শের বাস্তবায়নের পথে জীবনসংশয়ী হামলার শিকার হতে হয়েছে। ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানে থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা এবং তাঁর নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরাধিকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা মৌলবাদী ও পাকিস্তানপন্থীদের প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু পিতার মতই প্রাণভয়ে স্বীয় কর্তব্যের বিপদসঙ্কুল দুর্লঙ্ঘ্য কক্ষপথ থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা সম্ভব হয়নি। তাঁর নেতৃত্বে বাঙলার মাটিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মানসলালিত ৭২-এর সংবিধান পুনরায় কার্যকর হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীরা চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের বিচার চলমান, তাঁর নেতৃত্বে সোনার বাঙলা গড়ার পথে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি। প্রকৃতপক্ষে, আগস্ট মাস তাঁকে এবং আপামর বাঙালিকে যেমন দুর্মর শোক হেনেছে, তেমনি দুর্মর শক্তিও যুগিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা বঙ্গবন্ধু তাঁর সময়ের আপামর বাঙালির হৃদয়ে সঞ্চারিত করেছেন তা প্রজন্মান্তরে বহন করে নিয়ে যাবার। আর তাই আমরা আশাবাদী, বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ও চর্যার নিরিখে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটিয়ে গেছেন, তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও বিকাশ তাঁর আত্মজার নেতৃত্বে অব্যাহতগতিতে চলমান থাকবে। পঁচাত্তরের বিভীষিকাময় কালরাতে পিতা-মাতা, ভাই সকলকে হারিয়ে বাংলার গণমানুষের কাছে এসে, তাদের মাঝেই নিজ পরিবারকে ফিরে পেতে এবং তাদের নিয়েই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সফল হয়েছে কেননা তাঁর হাত ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে স্পর্ধিত পদবিক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তনয়া মামনীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে রূপকল্প ২১, ৪১ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের পথে দক্ষতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নির্ভীক দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদিন গিয়ে দাঁড়াবে বিশ্বের সর্বোন্নত দেশগুলির পাশে–এই প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক: কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও সাবেক উপ-উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
তথ্যসূত্র
বাংলাপিডিয়া, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৩
হিস্টরি অব বাংলাদেশ, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৯৭
বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্র-পত্রিকা
অন্তর্জাল